প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে মন্তব্য করেছেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দল পরিবর্তনের পরও একটা এলাকা থেকে বার বার জিতে আসা এটা মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতারই প্রমাণ হয়।
রবিবার বিকালে একাদশ জাতীয় সংসদের ১৯তম অধিবেশনে প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তার আগে শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন সংসদ নেতা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি (ফজলে রাব্বী মিয়া) আমাদের ছাত্রলীগ, যুবলীগ করেছেন, আওয়ামী লীগ করেছেন। এরপর জাতীয় পার্টিতে গিয়েছিলেন। পুনরায় তিনি আওয়ামী লীগের ফিরে আসেন। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসার পর আমরা তাকে সম্মান জানাই। পরে তাকে ডেপুটি স্পিকারের মর্যাদা দিয়েছিলাম। দল পরিবর্তনের পরও একটা এলাকা থেকে বার বার জিতে আসা এটা মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতারই প্রমাণ হয়। তিনি যে এলাকায় বার বার নির্বাচিত হয়েছেন সেই এলাকাটা ছিল অবহেলিত, মঙ্গা কবলিত, আমরা যখন ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসি তখন সেখানে যাতে পরিস্থিতির উন্নয়ন হয় সেজন্য আমরা কাজ করেছি। তিনি পিছিয়ে পড়া ঐ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তিনি যখন আমার কাছে আসতেন নিজের এলাকা নিয়ে কথা বলতেন। ওই এলাকার আরও উন্নয়ন দরকার সে বিষয়ে তিনি কথা বলতেন। আসলে তিনি মানুষের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন। তার মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি যখন আমেরিকা চিকিৎসার জন্য গেলেন প্রতিদিন আমি তার স্বাস্থ্য বুলেটিন পেতাম। তার সঙ্গে যারা নিয়োজিত ছিলেন তারা আমাকে সব সময় তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজ-খবর জানাতেন। কিন্তু একের পর এক অবনতির খবরই আসতে থাকে। তার মৃত্যুতে আমরা একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানকে হারালাম। ভালো আইনজীবীকে হারালাম। আসলে আমরা বার বার সংসদ সদস্যদের হারাচ্ছি। এটা একটা খুব দুঃখজনক।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিকাল ৫টায় সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনের শুরুতেই শোক প্রস্তাব আনা হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শোক প্রস্তাবটি পড়ে শোনান। এরপর মরহুমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অধিবেশনে উপস্থিত এমপিরা এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। এরপর মরহুমদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। এরপর নতুন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করা হয়।
শোক প্রস্তাবে অংশ নিয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই আগস্ট মাস, আসলে আমাদের জন্য খুব কষ্টকর। একে একে অনেককে সংসদ সদস্যকে আমরা হারিয়েছি। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছি। ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, ভাইসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হারিয়েছি। শোকের মাসে আরেকটি শোক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াকে হারিয়েছি।
তিনি বলেন, স্বজন হারানো বেদনা আমি বুঝি। দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানকে হারালাম। বিজ্ঞ আইনজীবীকে হারালাম। তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রাক্তন সংসদ সদস্যও মারা গেছেন। সবাইকে শোক সইবার শক্তি দিক সেটাই চাই।
শোক প্রস্তাবে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের এমপি আমির হোসেন আমু বলেন, সদালপি বিনয়ী মানুষ ছিলেন। ৭৪ সালে প্রথম পরিচয়। যুবলীগের একটি আলোচনা তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। এরপর দীর্ঘদিন দেখা হয়েছে। জাতির পিতাকে হত্যার পর জেল থেকে বের হয়ে একদিন গাইবান্দায় যাই, সেখানে যুবলীগের বিশাল একটি জনসভা করে দিয়েছিলেন। এরপর জাতীয় পার্টিতে গেলেন। পরে আবার আওয়ামী লীগের এসেছিলেন। বিজ্ঞ সংসদ সদস্য ছিলাম। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হারিয়ে যখন আমরা তার (সুরঞ্জিতের) জায়গা কে পূরণ করবে? তখন ফজলে রাব্বী মিয়ার নাম আলোচিত হয়।
বিরোধী দলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, মরহুম এই রাজনীতিবিদ ১১ নম্বর সেক্টেরে প্রথম শ্রেণির একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করতেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ করলেও তিনি পরে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। জাতীয় পার্টির হুইপ, প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। খুবই স্বজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। ডেপুুটি স্পিকার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতিতে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে হারালাম। অজাত শত্রু ব্যক্তি ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে পছন্দ করতেন।
আওয়ামী লীগের এমপি বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ফজলে রাব্বী মিয়া জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন। গাইবান্ধা ছিল অবহেলিত এলাকা। যারা অবহেলিত এলাকায় উন্নত করতে ভূমিকা রেখেছেন। ফজলে রাব্বী মিয়া প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করতেন। ৮১ সালের পর উত্তরবঙ্গে যখন সফরে গেছি, তার সঙ্গে আমরা কাজ করেছি। সমস্ত মানুষের জন্য উনার বাড়ির দরজা খোলা ছিল। যেটা আমাদের অনেকের পক্ষে হয়নি। কোন কাজে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করতেন না।
আওয়ামী লীগের এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, উনি সাতবার এমপি হয়েছেন। পার্লামেন্টে তার অভিজ্ঞতা অনেক। তিনি সাদা মনের মানুষ ছিলেন। ছাত্রলীগ থেকে যুবলীগ করে সামরিক বিরোধী আন্দোলন করেছেন। আইনজীবী ছিলেন। তাকে হারিয়ে আমরা সৎ, আদর্শবান রাজনীতিবিদ হারিয়েছি। তিনি কারও প্রতি বিরূপ কোন মনোভাব ছিল না। দলমত নির্বিশেষে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। দলের জন্য ত্যাগী নেতা, মানুষ দরদিকে হারিয়েছি।
আওয়ামী লীগের এমপি অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ফজলে রাব্বী মিয়া আইনজীবী হিসেবে গাইবান্ধায় কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টে সর্বশেষ পর্যন্ত ছিলেন। ছাত্ররাজনীতি, যুব রাজনীতি করতেন। মাঝখানে জাতীয় পার্টিতে গিয়েছিলেন সত্য। সবার সাথে সুর্ম্পক বজায় রেখেছেন। তার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ যেনবেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান দেয়।
জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, আগস্ট মাস শোকের মাস। এই মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সপরিবারকে হারিয়েছি। পাকিস্তান আমলে ফজলে রাব্বী মিয়ার সঙ্গে ছাত্রলীগ করেছি। কষ্ট করে মিটিংয়ে আসতেন। যুদ্ধের পর যখন যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হলো তখন যুবলীগে যোগদান করলেন। এরপর কাকতালীয়ভাবে জাতীয় পার্টিতে দেখা হলো তার সঙ্গে। আমাকে বলতেন আমরা কিভাবে আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পার্টিতে আসলাম, সেজন্য রিসার্চ দরকার। আগাগোরা তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক কর্মী। জনগণের সেবক। মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন।
আওয়ামী লীগের এমপি শাজাহান খান বলেন, একজন অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি সংসদে মোনাজাত করতেন, মনে হতো অভিজ্ঞ একজন আমেল। স্পিকার ব্যারিস্ট্রার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ উঠেছিল, ফজলে রাব্বী মিয়া সেই তদন্তের কাজে ছিলেন। খুব সুনিপণভাবে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। তার মরদেহ নিয়ে আমি তার নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছিলাম। দেখেছি, কত ভালোবাসতেন তার এলাকার মানুষ। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, বিনয়ী সৎ মানুষকে হারিয়েছি।
আওয়ামী লীগের এমপি আ স ম ফিরোজ বলেন, বণাঢ়্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টি থেকে এমপি, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি, যুবলীগের রাজনীতি করতেন। তিনি ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। যখন সংসদে মোনাজাত করতেন, তখন চোখের পানি রাখা ধরে রাখা যেতো না। তার চলে যাওয়া অপপূরণীয়।
জাতীয় পার্টির এমপি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা শোকাহত। আপনার (স্পিকারের) আসনে বসতে দেখতাম। তিনি ছোট বয়সে ছাত্ররাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টি থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের যোগদান করেন। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে তিনি ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। যার কোন শত্রু ছিল না। সকলের সাথে সুন্দর ব্যবহার করতেন।
জাতীয় পার্টির এমপি মশিউর রহমান রাঙা বলেন, অত্যান্ত ভালো মানুষ হিসেবে আমি তাকে দেখেছি। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
এছাড়াও জাতীয় সংসদের হুইপ মাহবুব আরা গিনি, হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন শোক প্রস্তাবের উপর বক্তব্য রাখেন।
0 মন্তব্যসমূহ